
এবিএম নুরুল হক | বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪ | প্রিন্ট | 183 বার পঠিত
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ তারিখে প্রকাশিত একটি স্মারকলিপি প্রকাশ করে। স্মারকের বিষয় হচ্ছে, সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ অনুযায়ী তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বীমা বাতিল করা প্রসঙ্গে। স্মারকে যা বলা হয়েছে তা নিম্নরূপ:
“উপর্যুক্ত বিষয়ে সুত্রস্থ পত্রের প্রেক্ষিতে জানানো যাচ্ছে যে, মোটরযান অধ্যাদেশ, ১৯৮৩-এর ধারা ১০৯ অনুযায়ী তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বীমা বাধ্যতামূলক ছিল এবং এর অধীনে ১৫৫ ধারার দন্ডের বিধান ছিল। তবে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর ধারা ৬০-এর উপধারা (১), (২) ও (৩) নিম্নরূপ:
১. কোন মোটরযানের মালিক বা প্রতিষ্ঠান ইচ্ছা করিলে তাহার মালিকানাধীন যে কোন মোটরযানের জন্য যে সংখ্যক যাত্রী বহনের জন্য নির্দিষ্টকৃত তাহাদের জীবন ও সম্পদের বীমা করিতে পারিবে। মোটরযানের মালিক বা প্রতিষ্ঠান উহার অধীন পরিচালিত মোটরযানের জন্য যথানিয়মে বীমা করিবেন এবং মোটরযানের ক্ষতি ও নষ্ট হওয়ার বিষয়টি বীমার আওতাভুক্ত থাকিবে এবং বীমাকারীকর্তৃক উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পাইবার অধিকারী হইবেন।
মোটরযান দুর্ঘটনায় পতিত হইলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হইলেবা নষ্ট হইলে উক্ত মোটরযানের জন্য ধারা ৫৩-এর অধীন গঠিত সার্বিক সহায়তা তহবিল হইতে কোন ক্ষতিপূরণ দাবি করা যাইবে না।অর্থাৎ এধারা অনুযায়ী, তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বীমা বাধ্যতামূলক নয় এবং আইনের অধীন ইহা লঙ্ঘন করা হলে কোনো দন্ডের বিধান নেই।
২. এমতাবস্থায় , তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বীমা না থাকলে সংশ্লিষ্ট মোটরযান বা মোটরযান মালিকের বিরুদ্ধে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ অনুযায়ী কোনো মামলা দেয়ার সুযোগ নাই।
৩. বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সকলকে অবগত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হলো।
সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ এর উপরে উল্লেখিত আইনের পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ নিম্নে উল্লেখিত সার্কুলার নং – নন-লাইফ ৮২/২০২০ (স্মারক নং ৫৩.০৩.০০০০.০৭৫.২২.০২৬.১৮.৩৯, তারিখ ঃ ২১ ডিসেম্বর ২০২০) জারী করে তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বীমা Third Party Insurance বা Act Liability সম্পর্কিত বীমা প্রোডাক্ট বা পরিকল্পটি বাতিল বলে নির্দেশ জারী করে:
Motor Vehicles Ordinance, 1983 (Ordinance No. LV of 1983) এর ১০৯ ধারা মোতাবেক দেশের সকল মোটরযান ও তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বীমা (Third Party Insurance or Act Liability) বাধ্যতামূলক ছিল। উক্ত Ordinance রহিতক্রমে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ (২০১৮ সালের ৪৭ নং আইন) প্রতিস্থাপিত হয়। সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ –এর ধারা ৬০ এর উপধারা (১) ও (২) নিম্নরূপঃ
“৬০। যাত্রী বা মোটরযানের বীমা-(১) কোনো মোটরযানের মালিক বা প্রতিষ্ঠান ইচ্ছা করিলে তাহার মালিকানাধীন যে কোনো মোটরযানের জন্য যে সংখ্যক যাত্রী পরিবহনের জন্য নির্দিষ্টকৃত তাহাদের জীবন ও সম্পদের বীমা করিতে পারিবে।
(২) মোটরযানের মালিক বা প্রতিষ্ঠান উহার অধীন পরিচালিত মোটরযানের জন্য যথানিয়মে বীমা করিবেন এবং মোটরযানের ক্ষতি বা নষ্ট হওয়ার বিষয়টি বীমার আওতাভুক্ত থাকিবে এবং বীমাকারী কর্তৃক উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পাইবার অধিকারী হইবেন।”
বর্ণিতাবস্থায়, তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বীমা (Third Party Insurance or Act Liability) সম্পর্কিত বীমা প্রডাক্ট বা পরিকল্পটি এই সার্কুলার জারীর তারিখ হতে বাতিল করা হলো। তবে ইতোমধ্যে ইস্যুকৃত তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বীমা পলিসিসমূহ মেয়াদপূর্তি পর্যন্ত বহাল থাকবে।
পাঠকদের অবগতি ও পরিষ্কার ধারণা দেয়ার জন্য মোটরযান অধ্যাদেশ, ১৯৮৩-এর ধারা ১০৯, ১২৩ ও ১৫৫ নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
ধারা ১০৯। তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকির জন্য বীমার প্রয়োজনীয়তা:
যাত্রী না হইলে কোনো ব্যক্তি কোন প্রকাশ্য স্থানে কোনো মোটরযান ব্যবহার করিবেন না বা ব্যবহারে পাঠাইবেন না বা অন্য কাহাকেও তাহা ব্যবহার করিতে দিবেন না, যদি সেই ব্যক্তি বা সেই অন্য ব্যক্তি কর্তৃক যাহার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সেখানে মোটরযান ব্যবহারের জন্য এই অধ্যায়ে বর্ণিত শর্ত পূরণকারী বীমার কোন নীতি প্রচলিত না থাকে।
ধারা-১২৩। বীমা সার্টিফিকেট প্রদর্শন:
যে কোন প্রকাশ্য স্থানে মোটরযান চালনাকারী কোন ব্যক্তিকে কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত সাব-ইন্সপেক্টরের নিচে নহে, এমন ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশ অফিসার অথবা মোটরযানের কোনো পরিদর্শক অথবা কর্তৃপক্ষ হইতে অনুমোদিত অপর কোন ব্যক্তিবর্গ চাহিবামাত্র যানে ব্যবহার সংক্রান্ত বীমার সার্টিফিকেট দেখাইতে হইবে।
ধারা-১৫৫। অবীমাকৃত মোটরযান চালনা:
কোন ব্যক্তি ১০৯ ধারার বিধান লঙ্ঘন করিয়া মোটরযান চালাইলে কিংবা চালানোর অনুমতি দিলে সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা জরিমানা শাস্তি পাইবার যোগ্য হইবেন।
উপরের বর্ণিত বিলুপ্ত আইনের ধারাসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে বিগত সরকারের আমলে একটি ভালো আইনকে (মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩) পরিবর্তন করে আর একটি অস্পষ্ট ও ক্ষতিকর আইন (সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮) চালু করা হয়েছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বীমা বা এ্যাক্ট লায়াবিলিটি বীমার প্রয়োজনীয়তা, সুবিধা ও লক্ষ্য সম্পর্কে একটু ধারণা দিতে চাচ্ছি: ব্রিটিশদের প্রায় দুইশত বৎসরের শাসনামলে অবিভক্ত ভারতবর্ষে যে দু-চারটি ভালো কাজ করেছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বীমা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে (১৭৯৭ সাল থেকে ১৮১০ সাল) কলকাতায় ৭টি নৌবীমা কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ থেকেই এদেশে বীমার কার্যক্রম শুরু হয়। গত প্রায় সাড়ে তিনশো বৎসর অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে বর্তমান অবস্থায় বীমার প্রসার লাভ করেছে। আমাদের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে মোটরযান বীমার বিষয়। তাই আলোচনা মোটরযান বীমা সম্পর্কে সীমাবদ্ধ রাখবো।
ইউরোপে গাড়ি আবিষ্কারের পর ১৮৯৪ সালে মোটরযান ইংল্যান্ডে প্রবেশ করে। প্রথমদিকে মোটরযান দ্বারা দুর্ঘটনা ঘটলে কোনো ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা ছিল না। পরবর্তীতে ১৮৯৮ সালে ল’ অ্যাকসিডেন্ট ইন্স্যুরেন্স সোসাইটি লিমিটেড মোটর বীমার কার্যক্রম শুরু করে। ক্রমে রাস্তাঘাটের প্রসারের ফলে মোটর গাড়ির চলাচলও বৃদ্ধি পায়। এতে দুর্ঘটনাও বৃদ্ধি পায় এবং তৃতীয়পক্ষ অর্থাৎ পথিক ও রাস্তায় চলাচল করা জনগণ এবং তৃতীয়পক্ষের অর্থাৎ জনগণের সম্পত্তি দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে থাকে। ১৯৩০ সালে রোড ট্রাফিক আইন প্রবর্তন করা হয়, যার মাধ্যমে বাধ্যতামূলক বিধিবদ্ধ দায়মুক্ত বীমা ((Act Liability Insurance) চালু করা হয়, যা দ্বারা দুর্ঘটনায় তৃতীয়পক্ষের কোনো ক্ষতি হলে তা পূরণ করা বাধ্যতামূলক করা হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ইংল্যান্ডের বীমা কোম্পানিসমূহ ট্রান্সপোর্ট মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় মোটর ইন্স্যুরেন্স ব্যুরো (Motor Insurance Bureau) স্থাপিত হয়, উদ্দেশ্য হচ্ছে যেখানে কোন বীমা নাই, সেখানে তৃতীয়পক্ষের দাবি পরিশোধ বাধ্যতামূলক করা।
মোটরযান বীমার ঝুঁকির দুই ভাগে ভাগ করা হয় যেমন:
ক) বিধিবদ্ধ দায় বীমা (Act. Liability Insurance ) বা তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বীমা (Third Party Insurance)।
খ) সর্বঝুঁকি বীমা (Comprehensive Insurance)|
আমাদের আলোচনার বিষয় যেহেতু তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বীমা সম্পর্কিত, সেহেতু সর্বঝুঁকি বীমা সম্পর্কে এখানে কোন বিশদ আলোচনার অবতারণা করবো না।
মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩-এর ধারা ১০৯, ১২৩ এবং ১৫৫ ধারা রহিত করে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর ধারা ৬০-এর উপধারা (১), (২) ও (৩) জারি করা হয়েছে, যা খুবই দুর্বল ও অকার্যকর। উপধারা (১) এ বলা হয়েছে কোনো মোটরযানের মালিক ইচ্ছা করিলে তাহার মালিকানাধীন যে কোনো মোটরযানের জন্য যে সংখ্যক যাত্রী পরিবহনের জন্য নির্দিষ্টকৃত তাহাদের জীবন ও সম্পদের বীমা করিতে পারিবে।
প্রথমত. আমাদের দেশে ইচ্ছা করে কেউ বীমি করে না। সে ধরণের মনমানসিকতা এখনও তৈরী হয়নি। প্রকৃত চিত্র হচ্ছে, তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বীমা বাতিল করার পর অনেক মোটরযানের মালিক কোনো বীমা করতে চান না। ফলে মোটর মালিকদের সর্বঝুঁকি বীমা (Comprehensive Insurance) ও অনেক কমে গেছে। শুধু যারা ব্যাংক ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনছেন তারাই বাধ্য হয়ে বীমা করছেন। Comprehensive Motor Insurance -এর প্রিমিয়াম বেশি হওয়ায় এই বীমা করতে চান না। এ কারণে মোটরযান বীমা প্রিমিয়াম আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে।। বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক প্রকশিত ২০১৯ সালের ইন্স্যুরেন্স ইয়ার বুক অনুসারে ২০১৯ সালে গ্রোস মোটর ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম আয় হয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। ২০২০ সালে তা কমে ৩৫৬.৫৫ কোটি, ২০২১ সালে ৩১৮.৬৪ কোটি এবং ২০২২ সালে ৩১৩.৪৯ কোটিতে দাড়িয়েছে। অর্থাৎ তৃতীয়পক্ষ বীমা বন্ধ করাতে মোটর বীমার প্রিমিয়াম ক্রমশ: হ্রাস পাচ্ছে এবং সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।এ ছাড়াও বীমা পেশায় নিয়োজিত কয়েক হাজার লোক বেকার হয়েছে, যারা তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বীমা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। ইতিমধ্যে অধিকাংশ নন-লাইফ কোম্পানির শাখা অফিসে যারা শুধু মোটরযান বীমা বিক্রী করতো ঐ সমস্ত শাখা অফিস বন্ধ হয়ে গেছে এবং এরকম অবস্থা চলতে থাকলে আরো অনেক শাখা অফিস বন্ধ হবে।
দ্বিতীয়ত. সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ এর ধারা ৬০-এর উপধারা (১) এ উল্লেখ আছে, “যে কোনো মোটরযানের জন্য নির্দিষ্টকৃত যাত্রী তাহাদের জীবন ও সম্পদের বীমা করিতে পারিবে।” অর্থাৎ রাস্তাঘাটে চলাফেরা করা তৃতীয়পক্ষ অর্থাৎ পথিক, পাবলিক প্লেসে চলাফেরা করা জনসাধারণের জীবন এবং তৃতীয়পক্ষের কোনো সম্পদের কোনো নিরাপত্তা থাকলো না। যন্ত্রদানব বাস ও ট্রাক পথচারীদের মেরে ফেলবে অথচ তার কোনো নিরাপত্তা থাকবে না বা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা থাকবে না। এই আইনের ধারা আমাদের সংবিধানের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত ২৭ ও ৩২ ধারার পরিপন্থী। এই ধারাসমূহে যা বলা হয়েছে তা নিম্নরূপ:
ধারা ২৭। সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী।
ধারা ৩২। আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।
মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ বাতিল করে (ধারা ১০৯) সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ এর ধারা ৬০-এর উপধারা (১) জারি করা হয়, যা আমাদের সংবিধানের ২৭ ও ৩২ ধারার পরীপন্থী বলে প্রতীয়মান হয়।
তৃতীয়ত.জাতীয় বীমা নীতি, ২০১৪-এর কয়েকটি ধারা নিম্নে উল্লেখ করছি, যা সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ এর ধারা ৬০-এর উপধারা (১) ও (২) এর সাথে সাংঘর্ষিক। বীমা নীতির নিম্নেবর্ণিত ধারাসমূহ পর্যালোচনা করা যেতে পারে:
ধারা ২.১ রূপকল্প (Vision): সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে, আপামর জনসাধারণকে ধাপে ধাপেবীমার আওতায় নিয়ে এসে জীবন, স্বাস্থ্য ও সম্পদের বিভিন্ন অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলার মাধ্যমে অন্যতম মানবাধিকার হিসেবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
ধারা২.২মিশন (Mision) :দেশের সম্পদ ও জীবনের ঝুঁকির শতভাগ বীমার আওতায় নিয়ে আসা।
২.৪.৭ বীমা ও দায়: দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি কারণে ক্ষতিগ্রস্ত সম্পদের যেমন আর্থিক ক্ষতিপূরণ বীমার মাধ্যমে করা হয়, তেমন বীমা গ্রহীতার অবহেলা কিংবা অজ্ঞতাবশত কোন কাজের মাধ্যমে তৃতীয়পক্ষের নিকট সৃষ্ট দায়ের জন্যও ক্ষতিপূরণ বীমার মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। রাস্তায় গাড়ি চালালে, উৎপাদিত পণ্যের ব্যবহারে ক্ষতি, পেশাগত দায়িত্ব পালনের ফলে সৃষ্ট ক্ষতি ইত্যাদি কারণে তৃতীয়পক্ষ কিংবা তাদের সম্পত্তিক্ষতিগ্রস্ত হলে বীমা গ্রহীতার আইনগত দায় সৃষ্টি হয়। এ সকল দায়ের ঝুঁকি গ্রহণ করে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে তৃতীয়পক্ষকে জীবন ও সম্পদের ক্ষতিপূরণে বীমার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
এ ছাড়া জাতীয় বীমা নীতির ২০১৪-এর ধারা ২.৫ প্রধান প্রতিপালনীয় বিষয়সমূহ এর উপধারা (২) ও (৭) বর্ণিত বিষয়ে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর বীমাসংক্রান্ত ধারা ৬০-এর উপধারা (১) ও (২) সাংঘর্ষিক।
ধারা ২.৫ প্রধান প্রতিপালনীয় বিষয়সমূহ:
২) বীমাসংক্রান্ত প্রচলিত আইনকানুন এবং অন্যান্য যেসব আইনে বীমাসংক্রান্ত বিধান আছে, এগুলো পর্যালোচনা করে যথাযথ আইনি কাঠামো নিশ্চিত করা হবে।
৭) বীমা আইনের সাথে সাংঘর্ষিক আইনসমূহ পর্যালোচনা করা হবে।
জাতীয় বীমা নীতির ২০১৪-এর উপরোক্ত ধারাসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, মোটরযান অধ্যাদেশ, ১৯৮৩ বাতিল করে যে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ জারি করা হয়েছে তার ধারা ৬০-এর উপধারা (১) ও (২)।
জাতীয় বীমা নীতির ২০১৪-এর ধারা ২.১, ২.২, ২.৪.৭ এবং ধারা ২.৫ এর উপধারা ২ ও ৭ এর সাথে সাংঘর্ষিক।
চতুর্থত. বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি কর্তৃক প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুসারে দেখা যায় যে, ২০১০ সাল পর্যন্ত রেজিস্ট্রিকৃত বিভিন্ন ধরণের গাড়ির সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ ২৭ হাজার ৩৬৮ যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০২১ সালেদাড়িয়েছে ৫০ লাখ ১৩ হাজার ৯০৮, ২০২২ সালে দাড়িয়েছে ৫৫ লাখ ৯২ হাজার ৫৯, ২০২৩ সালে দাড়িয়েছে ৫৯ লাখ ৫২ হাজার ৯২০। অর্থাৎ ১৩ বছওে গাড়ির সংখ্যা চারগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সমস্ত গাড়ির বীমা বাধ্যতামূলক করা হলে বীমার প্রিমিয়াম আয় বাড়বে, জনসাধারণের অর্থাৎ তৃতীয়পক্ষের মৃত্যু, আহত ও পঙ্গু হওয়ার ঝুঁকি ও এবং সম্পদের ক্ষতি বীমার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ করার নিশ্চয়তা বিধান করা হবে। দেশের রাস্তাঘাট যত সম্প্রসারিত হবে বিভিন্ন ধরণের গাড়ির সংখ্যাও তত বৃদ্ধি পাবে। সঙ্গে সঙ্গে দুর্ঘটনার সংখ্যাও বাড়বে। বর্তমানে প্রতিদিনই রাস্তায় মোটরযানের মাধ্যমে দুর্ঘটনায় হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছে।আহত হচ্ছে ও পঙ্গুত্ব বরণ করছে। কিন্তু তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বীমা বাধ্যতামূলক না থাকাতে নিরীহ নাগরিকরা কোনো আইনি সুবিধা বা ক্ষতিপূরণ পাবে না। যা কোনো রকমেই কাম্য নয় এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার পরিপন্থিী।
প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ্য যে, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এর ধারা ৫২, ৫৩ অনুসারে দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা ইত্যাদির বিধান করা হয়েছে। ধারাসমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
ধারা ৫২।-ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তাহার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান : কোনো মোটরযান হইতে উদ্ভুত দুর্ঘটনার ফলে কোনো ব্যক্তি আঘাতপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হইলে বা আঘাতপ্রাপ্ত হইয়া মৃত্যুবরণ করিলে উক্ত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা ক্ষেত্রমতে তাহার উত্তরাধিকারীগণের পক্ষে মনোনীত ব্যক্তি ধারা ৫৩-এর অধীন গঠিত আর্থিক সহায়তা তহবিল হইতে ট্রাস্টি বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে চিকিৎসার খরচ প্রাপ্য হইবে।
ধারা ৫৩।-আর্থিক সহায়তা তহবিল-(১) ধারা ৫২-এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, আঘাতপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির অনুকূলে বা ক্ষেত্রমতে, মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের লক্ষ্যে আর্থিক সহায়তা তহবিল নামে একটি তহবিল গঠিত হইবে।
(২) কর্তৃপক্ষ বিধি দ্বারা নির্ধারিত হারে ও পদ্ধতিতে মোটরযানের মালিক বা প্রতিষ্ঠানের নিকট হইতে মোটরযানের শ্রেণিবিন্যাস বিবেচনাক্রমে প্রত্যেক মোটরযানের বিপরীতে আর্থিক সহায়তা তহবিলের জন্য বাৎসরীক বা এককালীন চাঁদা আদায় (Contibution) করিবে।
এই আর্থিক সহায়তা তহবিল গঠিত হয়েছে কিনা আমার জানা নেই বা হয়ে থাকলে এই তহবিল থেকে কোনো দুর্ঘটনা-কবলিত ব্যক্তির পরিবার বা আহত ব্যক্তি কোনো আর্থিক সহায়তা পেয়েছে বলে জানা নেই।
নিম্নলিখিত কারণে এই তহবিল অকার্যকর এবং অবাস্তব:
প্রথমত. এই তহবিলের মাধ্যমে তৃতীয়পক্ষের সম্পত্তি নষ্টজনিত ক্ষতির সহায়তা করার ব্যবস্থা রাখা হয়নি অথচ তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বীমায় তৃতীয়পক্ষের সম্পত্তির ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা ছিল।
দ্বিতীয়ত. মোটরযান হইতে উদ্ভুত দুর্ঘটনার ফলে কোনো ব্যক্তি আঘাতপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হইলে তার ক্ষতিপূরণ আর্থিক সহায়তা তহবিল থেকে আদায় করা এক জটিল কাজ হবে। দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুও কারণ প্রমাণ করা, মৃত্যুর সনদপত্র জোগাড় করা বা আহত হলে হসপিটালে চিকিৎসার খরচ আদায় করা কঠিন হবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ ধরণের দুঘৃটনাজনিত ক্ষতিপূরণ কোথা থেকে করবে, অর্থাৎ আর্থিক সহায়তা তহবিল সংস্থার কার্যালয়ে কি প্রত্যেক জেলায় জেলায় স্থাপন করা হবে। আর তা যদি করতে হয় তাহলে ঐ তহবিলে অর্থ প্রশাসনিক খরচ বহন করতেই ব্যয় হয়ে যাবে এবং তখন দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণের জন্য কোনো তহবিল থাকবে না। তাছাড়া আমাদের দেশে সরকারি সংস্থার আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং লাল ফিতার দৌরাত্ম্য সর্বজনবিদিত।
পক্ষান্তরে বীমা কোম্পানির আওতায় তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বীমা করা থাকলে মোটরযানের মাধ্যমে সংঘটিত কোন দুর্ঘটনার দ্বারা মৃত্যু হলে বা আহত হলে ক্ষতিপূরণ আদায় করা তুলনামুলক সহজ হবে। কেননা দেশের প্রধান প্রধান বাণিজ্যিক স্থানে বীমা কোম্পানির শাখা আছে বা প্রতিনিধিরা কর্মরত আছে। তাছাড়া বীমা কোম্পানি কর্তৃক দাবি পরিশোধের ব্যাপারে দায়বদ্ধতা রয়েছে এবং এ ব্যাপারে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) সর্বদা তদারকি করে থাকে। তবে এই (ধারা ৫৩) তহবিলের একটা কাজ হতে পারে যদি কোন গাড়ির তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বীমা না করা থাকে, তাহলে ঐ সমস্ত মোটরযান কর্তৃক সংঘটিত দুর্ঘটনার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে বা তার উত্তরাধিকারীকে আর্থিক সহায়তা করা। তবে সার্বিকভাবে আর্থিক সহায়তা তহবিল কোনোভাবেই বীমার বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে না। গত প্রায় ৩৫০ বৎসর যাবৎ বীমা ব্যবস্থা চালু আছে এবং আইনের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। আমাদের আশপাশের দেশসমূহ যথা- ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ সব দেশেইতৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বীমা বলবৎ আছে। এ ছাড়া ইউএসএ, ইউকে, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশে অ্যাক্ট লায়াবিলিটি ইন্স্যুরেন্স বা তৃতীয়পক্ষের ঝুঁকি বীমা চালু আছে। হঠাৎ করে আমাদের দেশে এই বীমা বাদ দেয়ার কী কারণ থাকতে পারে, তা আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না।
উপর্যুক্ত বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে, বীমা বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন যে, সাবেক সরকারের আমলে প্রবর্তিত সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ বাতিল পূর্বক মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ পূন:প্রবর্তন করা প্রয়োজন। তবে তৃতীয়পক্ষ বীমার প্রিমিয়ামের হার বৃদ্ধি করে ক্ষতিপূরণের হার অর্থাৎ মৃত্যু, মারাত্মকভাবে আহত, সাধারণভাবে আহত এবং তৃতীয়পক্ষের সম্পর্কের ক্ষতিপূরণের অর্থ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। প্রয়োজনে তৃতীয়পক্ষের বীমার নাম পরিবর্তন করে ‘মোটরযানের জন্য কল্যাণ বীমা’ও রাখা যেতে পারে। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করার জন্য আমি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
লেখক
প্রাক্তন ব্যবস্থাপনা পরিচালক
এবং বর্তমান সিনিয়র কনসালট্যান্ট
গ্লোবাল ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড
Posted ২:০৫ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪
প্রতিদিনের অর্থনীতি | Protidiner Arthonity